বাহরে শরীয়ত, মুজাদ্দেদে জামান, হযরত মাওলানা শাহ্ সূফি মোহাম্মদ মোহেব্বুল্লাহ ছাহেব (রহঃ) একটি জীবন ও আদর্শ
-আলহাজ্ব মির্জা নূরুর রহমান বেগ
গতবছরের এইদিনে আমরা হারিয়েছি আমাদের প্রাণপ্রিয় অভিভাবক, আধ্যাত্মিকতার এক মহান শিক্ষাগুরু ছারছীনা শরীফের মরহুম পীর ছাহেব বাহরে শরীয়ত, মুজাদ্দেদে জামান শাহ্ মোহাম্মদ মোহেব্বুল্লাহ (রহঃ) কে হারিয়েছি। একটি বছর হয়ে গেল হুজুর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর অবর্তমানে আজ আমরা তাঁর রেখে যাওয়া স্মৃতিগুলোকে স্মৃতিচারণ করে নিজেকে ধন্য করতে চাই।
জন্ম ও বংশ পরিচয় :
ইংরেজি ১৯৫০ সনে ও বাংলা ১৩৫৭ সনের এক শুভক্ষণে দক্ষিণ বাংলা বরিশালের পিরোজপুরের ছারছীনা নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মাওলানা শাহ্ মোহাম্মদ মোহেব্বুল্লাহ (রহঃ)। হুজুরের পূর্ণনাম আবু মাহবুব শামসুল আরেফীন শাহ্ মোহাম্মদ মোহেব্বুল্লাহ (রহঃ)। পিতার নাম শাহ্ আল্লামা শাহ্ সূফী আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ (রহঃ), মাতার নাম মোসাম্মাত মনোয়ারা বেগম, দাদার নাম শাহ্ সুফী নেছারুদ্দীন আহমদ (রহঃ), তিনি বিখ্যাত আকন বংশে জন্মগ্রহণ করেন।
উপাধী লাভ :
তাঁর দাদা মারফতের সম্রাট শাহ সূফি নেছার উদ্দিন আহমদ (রহ.) তখনো জীবিত। হযরত মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ (রহ.) তদিয় ওসিয়ত নামায় উল্লেখ করেছেন- “একদা ওয়ালেদ সাহেব কেবলা তাঁর সামনে একটি চৌকিতে মোহেব্বুল্লাহকে বসালেন এবং বললেন এই হল শাহ সাহেব ”।
শিক্ষাজীবন :
১৯৬১ সনে ১১ বছর বয়সে তৎকালীন ছারছীনাতে প্রতিষ্ঠিত “আদর্শ মাদ্রাস” যা বর্তমানে “দীনিয়া” মাদ্রাসা নামে পরিচিত উহাতে ভর্তি হন। ১৯৭৫ সনে কৃতিত্বের সাথে ছারছীনা কামিল মাদ্রাসা থেকে ১ম শ্রেণীতে কামিলে উত্তীর্ণ হন।
উল্লেখযোগ্য ওস্তাদগণ :
তাঁর শিশুকালের ওস্তাদ ছিলেন নাজিরপুর থানার কলারদোয়ানিয়া গ্রামের মৌলভী আব্দুল হামিদ সাহেব। এছাড়াও মুমতাজুল ফুকাহা আলহাজ্ব হযরত মাওলানা তাজাম্মুল হুসাইন খাঁন (রহঃ), বাংলার অদ্বিতীয় মুহাদ্দিস আল্লামা নিয়াজ মাখদুম খোত্তানী (রহঃ), বিশিষ্ট মুহাদ্দিস আব্দুস সাত্তার বিহারী (রহ.), মাওলানা আঃ কুদ্দুস ছাহেব (রহঃ), মাওলানা আজিজুর রহমান (রহঃ) তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপাল ছারছীনা কামিল মাদ্রাসা, হযরত মাওলানা আঃ মজিদ ছাহেব (রহঃ), হযরত মাওলানা আবুল খায়ের মোহাম্মদ আঃ আজিজ (রহঃ), হযরত মাওলানা সূফী আঃ রশিদ ছাহেব (রহঃ), হযরত মাওলানা রফিকুল্লাহ নেছারী (পটুয়াখালী হুজুর) প্রমূখ তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক ওস্তাদদের মধ্যে অন্যতম। দক্ষিণ বঙ্গের আরেক বরেণ্য আলেম হযরত মাওলানা তাজউদ্দীন সাহেব ও ছারছীনা মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ মাওলানা আমজাদ হোসাইন জামালপুরী হুজুর ব্যক্তিগত ওস্তাদ ছিলেন।
বিশেষ পা-িত্য অর্জন :
তিনি ছিলেন তীক্ষ্ম মেধার অধিকারী। যোগ্য ওস্তাদদের আন্তরিক তা’লীম ও শিক্ষার মাধ্যমে তিনি বিশেষ পান্ডিত্য অর্জন করতে থাকেন। আরবী, উর্দু, ফার্সি সহ বিভিন্ন ভাষায় যথেষ্ট মাহারাত ছিল তাঁর। নিরিবিলি এবং নির্জন পরিবেশ তিনি পছন্দ করতেন। গভীর রাতে রিক্ত প্রেমিকের মত তাকে ফার্সি বয়াত পড়তে দেখা যেত।
ইলমে তাসাউফ শিক্ষা :
তিনি তাঁর তদীয় পিতা শাহ্ সুফী আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ (রহঃ) থেকে ইলমে তাসাউফের গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।
বিবাহ শাদী ও আওলাদ :
একবার ফুরফুরা শরীফের পীর ছাহেব কেবলা হযরত মাওলানা আবু বকর সিদ্দিকী আল কুরাইশী তার প্রধান খলিফা ছারছীনা শরীফের হযরত পীর ছাহেব কেবলাকে বলেছিলেন খোলাফায়ে রাশেদীনের আবু বকর সিদ্দিকের সাথে রাসূল (সা.) এর যে সম্পর্ক বাবা নেছার তোমার সাথে আমার সেই সম্পর্ক। উক্ত কথার পরিপূর্ণতা লাভ করলো হুজুর কেবলার বিবাহের মাধ্যমে। ১৯৮০ সনে ফুরফুরা শরীফের গদ্দীনশীন পীর হযরত মাওলানা আবুল আনছার মোহাম্মদ আব্দুল কাহহার সিদ্দিকী সাহেবের প্রথমা কন্যাকে বিবাহ করেন। তিনি দুই পুত্র সন্তন ও তিন কন্যা সন্তান রেখে যান। পুত্রদ্বয় : বড় সাহেবজাদা আলহাজ্ব হযরত মাওলানা শাহ্ আবু নছর নেছারুদ্দীন আহমাদ হুসাইন (মা.জি.আ.) (বর্তমান গদ্দীনশীন পীর), ছোট সাহেবজাদা আলহাজ্ব হযরত মাওলানা হাফেজ শাহ্ আবু বকর মোহাম্মদ ছালেহ নেছারুল্লাহ (ছোট হুজুর কেবলা) (মা.জি.আ.)।
বিভিন্ন দায়িত্ব পালন :
১৯৭৫ সন থেকে ১৯৭৭ সন পর্যন্ত দুই বছর ছারছীনা দারুসসুন্নাত কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সনে বাংলাদেশ জমইয়াতে হিযবুল্লাহর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীরের পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৮৩ সনে ছালেহিয়া ট্রাস্টি বোর্ডের সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। একই সময়ে তিনি ছারছীনা মাদ্রাসার সেক্রেটারী নিযুক্ত হন। ১৯৮৩ সনে বাংলাদেশ জমিয়তে উলামার সেক্রেটারী নিযুক্ত হন। ১৯৯০ সনের ১৬ই ফেব্রুয়ারী শুক্রবার বাদ জুময়াহ ছারছীনা দরবার শরীফের পীর হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ এবং সকলকে তাজদীদি বাইয়াত করান। ১৯৯০ সন হতে ওফাতের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ জমইয়াতে হিযবুল্লাহর আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সন হতে ওফাতের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এছাড়াও ওফাতের পূর্ব পর্যন্ত ঢাকার মহাখালিস্থ মসজিদে গাউসুল আজমের মুতাওয়াল্লী ছিলেন।
বিভিন্ন সংগঠন/প্রতিষ্ঠান/অবকাঠামো প্রতিষ্ঠাকরণ :
১৯৭৭ সনে ছারছীনা শরীফের মাজারের পশ্চিমপার্শ্বে দারুল হাদীসের দ্বিতলে দারুচ্ছুন্নাত একাডেমি প্রতিষ্ঠা। ১৯৯৭ সনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মাসিক কুড়িমুকুল পত্রিকা। ২০০০ সালে এক যুগ ব্যাপি আলিয়া মাদ্রাসাকে সংশোধনের চেষ্টা করার পর ব্যর্থ হয়ে দ্বীনি এলেমকে রক্ষার্থে পুরাতন নেছাবের আদলে গড়া দারুল উলুম মাদ্রাসাকে ছারছীনা দারুচ্ছুন্নাত জামেয়া-এ-নেছারিয়া দ্বীনিয়া মাদ্রাসা নামকরণ করে দ্বীনিয়াকে নতুনভাবে ঢেলে সাজান। ২০০৫ সালে ছারছীনা শরীফে দীনিয়া মাদ্রাসা বোর্ড প্রতিষ্ঠা হয়, মরহুম হযরত পীর ছাহেব কেবলা “বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম” লিখে উহা উদ্বোধন করেন। এছাড়াও তিনি ২০১১ সনে বাংলাদেশ যুব হিযবুল্লাহ ও আইম্মায়ে হিযবুল্লাহ গঠন করে দেশের যুবসমাজকে একটি শক্তিশালী সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ করে খেদমতের এ গতিধারাকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ছারছীনা দরবার শরীফে সুবিশাল ছয় তলা বিশিষ্ট দ্বীনিয়া ভবন, মনোমুগ্ধকর দ্বীতলা ডাইনিং হল, সৌন্দর্যমন্ডিত রিজার্ভ পুকুর, ৩১৮ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট উপমহাদেশের সর্বোচ্চ মিনারা, দশ হাজার মুসুল্লী একত্রে নামাজ পড়তে পারে এমন বিশাল সাত তলা মসজিদ, চাকচিক্যময় হিযবুল্লাহ কমপ্লেক্স, রম্যহর্ম নয়নাভিরাম মাহফিল স্টেইজ, দিগন্ত বিস্তৃত মাহফিল ময়দান ও চোখ জুড়ানো মেহমান খানা তার অসামান্য কীর্তি। “জুলফিকার হামদ-নাত ও গজল পরিবেশক দল” নামে একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা। এই সুনিপুন স্থাপনা সমূহ অগণিত ভক্ত মুরিদ ও দর্শকদের কাছে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এক কথায় তার নিত্য নতুন স্থাপনা দরবারকে এক প্রাণবন্ত শহরে পরিণত করেছে।
দেশ-বিদেশ ভ্রমণ :
১৯৭৪ সনে পিতার সাথে প্রথম হজ্বব্রত পালন করেন। ১৯৮২ সনে তদীয় পিতার সাথে ইরাক সফর করেন। ১৯৯৪ সালে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হেসেনের দাওয়াতে “আলমে ইসলামী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে” তিনি যোগদান করেন এবং প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন কর্তৃক বিশেষ সম্মানে ভূষিত হন। সমগ্র দেশের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত পর্যন্ত হেদায়েতের উদগ্র বাসনা নিয়ে উল্কার গতিতে ছুটে বেরিয়েছেন তিনি। শুধু দেশেই নয়, বহির্বিশ্বেও তাঁর ব্যাপক বিচরণ ছিল। এ লক্ষ্যে ইরাক, আরব, ভারত, পাকিস্তান, মিশর, ফিলিস্তিন, সিরিয়া সফর করেছেন।
দেশ-বিদেশের মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন সমস্যায় সহযোগিতা :
১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার সহ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে সহায় সম্বলহীন দুস্থ ক্ষুধার্ত মানুষের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন তিনি। এছাড়াও ৯৮ এর বন্যা, একাধিক দুর্যোগ ও জাতীয় সংকট ও বিপদ-আপদে বিভিন্ন ধরনের ত্রাণ সামগ্রী, নগদ অর্থ নিয়ে ভূ-বক্ষে তাপিত জর্জরিত, নিরন্ন মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছাতেন তিনি। দুনিয়ার কোন স্থানে নির্যাতনের খবর শুনলে তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। মিটিং ডাকতেন, প্রতিবাদ জানাতেন, বিবৃতি দিতেন, খতম পড়াতেন, দোয়া করতেন, আল্লাহর সাহায্য কামনা করতেন। ভারতের বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গায়, কাশ্মীরের হত্যাকা-ে, আফগান নিপীড়নে, ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার খবরে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়তেন। তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানাতেন। মুনাজাতে রোনাজারী করতেন। নওমুসলিমদের পুনর্বাসন, সহায় সম্বলহীন দরিদ্র তলবে এলেমদের সহায়তা দান ছিল জীবনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ২০১৭ সালে মায়ানমারের বৌদ্ধ সামরিক জান্তা সরকার কর্তৃক অমানসিক নির্যাতনের শিকার আরাকান থেকে আগত মুসলমানদের সহায়তার জন্য তিনি রিলিফ সহ জমইয়াতে হিযবুল্লাহর কর্মী ভাইদেরকে নিয়ে তথায় উপস্থিতি ও সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন। ২০২১ সনে মরহুম হযরত পীর ছাহেব হুজুর কেবলার নির্দেশে তার বড় ছাহেবজাদা বর্তমান হযরত পীর ছাহেব কেবলা আলহাজ্ব হযরত মাওলানা শাহ্ আবু নছর নেছার উদ্দিন আহমাদ হোসাইন (মা.জি.আ.) এর নের্তৃত্বে ঢাকাস্থ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রদূত ইউসুফ রামাদানের সাথে সাক্ষাৎ করে মজলুম ফিলিস্তিনিদের জন্য সহায়তা প্রদান করেন। ২০২৪ সনে মরহুম হযরত পীর ছাহেব হুজুর কেবলার নির্দেশে তার বড় ছাহেবজাদা বর্তমান হযরত পীর ছাহেব কেবলা আলহাজ্ব হযরত মাওলানা শাহ্ আবু নছর নেছার উদ্দিন আহমাদ হোসাইন (মা.জি.আ.) এর নের্তৃত্বে ফেনী, চাঁদপুরে বন্যার্তদের ত্রাণ প্রদান।
বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের আগমন :
মরহুম হযরত পীর ছাহেব কেবলা ছিলেন বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। দেশ-বিদেশের রাজা-বাদশাহ, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিবিদ, পীর-মাশায়েখগণ তাঁর দরবারে ছুটে আসতেন। ১৯৯৯ সনে ইরাকের ইমামে আজম আবু হানিফা (রহ.) এর মাজার সংলগ্ন মসজিদের খতিব শায়খ হোসাইন হামদান, ধর্ম ও আওকাফ মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা মোস্তফা খুজায়ের ও হামিদ সাবান খোদাইরী, সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বংশধর শেখ ওয়ায়েল বিন নায়েল আল কুর্দি সহ বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ তাঁর কাছে সাক্ষাৎ করতে আসতেন।
আমল-আখলাক ও খোদাভীতি :
তিনি ছিলেন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, ধর্মভীরু, অমায়িক সহিঞ্চু, সৌন্দর্য পিপাসু, অধিক তাক্বওয়ার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শরীয়তের পাবন্দী, সুন্নতে নববীর অনুসরণে কোন মহাসমুদ্রের মহা সাইক্লোন কিছুই তাঁকে থামাতে পারত না। জিকির আজকার, তসবিহ তাহলিলে মশগুল থাকতে দেখা যেত সর্বাবস্থায়ইই তাঁকে। প্রতিমুহূর্তে বিদায়ের মলিন সুর তার কন্ঠে প্রতিভাত হত। জাঁকজমক ও আড়ম্বরের শীর্ষ স্থানে থেকেও জীবনের মিষ্টতা তাকে স্পর্শ করতে পারে নাই। ওপারের নিঃস্ব যাত্রার চরম মনোবেদনা নিরবে তার চিত্রপটে ভেসে থাকতো। যখনই চাওয়া-পাওয়ার বিস্ময়কর কিছু দেখতেন সাথে সাথে মৃত্যুর কথা উচ্চারণ করতেন। এত ব্যস্ততার মাঝেও কখনও তাঁর অজিফা ছুটতে দেখা যায় নাই। তার খোদাভীতি ও তাক্বওয়া যে কোন চিন্তাশীল মানুষকে হতবাক করে দেয়। সন্দেহ যুক্ত কোন মাল তিনি গ্রহণ করতেন না, খাইতেন না। উচ্চপদস্থ মানুষের হাদিয়াও তিনি বিনয়ের সহিত কখনও কখনও ফেরত দিতেন। তিনি যার তার পিছনে নামাজ পড়তেন না। শরীয়তে জায়েয থাকলেও অধিক তাক্বওয়ার খেয়ালে যেটা আওলা তিনি সেটার উপর আমল করতেন। আর পর্দা-পুশিদা ছিল কল্পনাতীত। বিশ্বজুড়েও তাঁর নজির পাওয়া সম্ভব নয়।
অসুস্থতা :
২০২৪ সন মাঘের মাহফিলের শেষ দিন। মাগরিবের নামাজ হয়েছে, তালিম হয়েছে, লক্ষ লক্ষ ভক্ত মুরীদের সামনে তাদের কলিজার টুকরা প্রাণপ্রিয় পীর শারিরীকভাবে অসুস্থ, সকলে ভগ্ন হৃদয়। কাহারও বুঝতে বাকি নাই মুর্শিদ আর বেশী দিন থাকবে না। জীবন সায়াহ্নের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়েছেন তিনি। তিনি স্টেইজে সকলের সামনে চেয়ারে বসলেন। নিষ্পাপ উজ্জ্বল পবিত্র চেহারার দিকে তাকিয়ে সকলের চোখে আসুর ফোয়ারা বয়ে যেতে রইলো। ভাবা বেগে তিনি নসিহত করলেন- “আমার পরে আপনারা এ দরবার দেখে রাখবেন। মাদ্রাসা, মসজিদ, দরবার, খানকাহ, দ্বীনিয়া মাদ্রাসা আপনাদের। বাতিলের সাথে কখনো আপোষ করবেন না। এ দরবারকে আমলের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখবেন। আমার পরে কাকে নিয়ে চলবেন তা অসিয়ত নামায় লেখা আছে, আপনার দেখে নিবেন”। কাহারও বুঝতে বাকি রইল না প্রিয়তম পীর আমাদের থেকে বিদায় নিচ্ছেন। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল সারা ময়দান। হুজুরের অসুস্থতা বাড়তে থাকলে জানুয়ারিতে প্রথমে ঢাকা ও পরে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নবী পাগল শায়খ এত অসুস্থতার মধ্যেও মদীনা শরীফ যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যান। রমজান মাসে জীবনেরন শেষ ওমরা পালন করেন।
ওফাত লাভ :
আমাদের মহান মুর্শিদ ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই, ২ শ্রাবন, ১০ মুহাররম, রোজ- বুধবার, রাত ২ টা ১১ মিনিটে তাহাজ্জুদের সময় ঢাকার গ্রীন রোডস্থ সেন্ট্রাল হসপিটালে মহান রবের জিকিররত অবস্থায় মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে সকলকে এতিম করে চিরতরে বিদায় নিলেন। কেঁদে উঠলো লক্ষ লক্ষ আশেক ও ভক্তকুল।
জানাযা ও দাফন :
হুজুরের ইন্তেকালের পরদিন ১৮ জুলাই বাদ জোহর ছারছীনা দরবার শরীফে তাঁর জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাযার নামাযের ইমামতি, সমবেত সকলকে তাজদীদি বাইয়াত ও সকলের উদ্দেশ্যে খুতবা প্রদান করেন তার বড় সাহেবজাদা বর্তমান গদ্দীনশীন পীর ছাহেব আলহাজ্জ হযরত মাওলানা শাহ্ আবু নছর নেছারুদ্দীন আহমাদ হুসাইন (মা.জি.আ.)। জানাযা শেষে পিতার পার্শ্বে তাঁকে দাফন করা হয়।